আসুন ভালো রাখি আমাদের কিডনি
আমাদের শরীর সুস্থ রাখতে যেসব অঙ্গ নিরন্তর কাজ করে, তার মধ্যে অন্যতম হলো কিডনি। আজ বিশ্ব কিডনি দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য, ‘সবার জন্য সুস্থ্ কিডনি’।
স্বাস্থ্যই সম্পদ। এই বাক্যের মর্মার্থ আমরা অসুস্থ হলে খুব ভালো করেই বুঝতে পারি। আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে যেসব অঙ্গ নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো কিডনি। কিডনি মূলত একটি ছাঁকনযন্ত্র। মানবদেহে দুটো কিডনি থাকে। এটি আমাদের রক্ত থেকে দূষিত পদার্থ দেহের বাইরে বের করে দেয়।
কিডনির প্রধান কাজগুলো হলো—
রক্তের পরিশোধন
কিডনি দেহের বিপাকের ফলে উৎপন্ন বর্জ্য পদার্থগুলো মূত্র সৃষ্টির মাধ্যমে দেহ থেকে বের করে দেয়, ফলে রক্ত বর্জ্যমুক্ত হয়ে পরিশোধিত হয়।
দেহে পানির সমতা বজায় রাখা
দেহে পানি স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হলে কিডনি বেশি মূত্র তৈরি করে আবার পানির ঘাটতি থাকলে কম মূত্র সৃষ্টির মাধ্যমে কিডনি দেহে পানির সমতা বজায় রাখে।
কিডনি সুস্থ রাখতে ফাস্ট ফুড, প্রক্রিয়াজাত খাবার, লবণযুক্ত খাবার, অতিরিক্ত প্রাণিজ আমিষ পরিহার করে শাকসবজি ও আঁশজাতীয় খাবার বেশি বেশি খেতে হবে। কিডনি সুস্থ রাখতে কোমল পানীয় যতটা সম্ভব পরিহার করে চলতে হবে।
অম্ল ও ক্ষারের সমতা বজায় রাখা
কিডনি দেহের খনিজ লবণ ও বাইকার্বনেটের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অম্ল–ক্ষার সমতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ
দেহের পানির সমতা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে, বিভিন্ন হরমোনের সাহায্যে কিডনি রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণ করে।
লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদন
আমাদের দেহে লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদনে ইরাইথ্রোপয়েটিন নামক একটি হরমোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এই হরমোন কিডনি থেকেই উৎপন্ন হয়।
মজবুত হাড় ও দাঁতের গঠন
কিডনি ভিটামিন ডির কার্যকর রূপ তৈরিতে প্রধান ভূমিকা রাখে। ভিটামিন ডি হাড় ও দাঁতকে মজবুত করে।
কিডনি বৈকল্যের কারণ
কিডনির বৈকল্য দুইভাবে দেখা দিতে পারে। একটি হলো তাৎক্ষণিক বৈকল্য, অপরটি হলো দীর্ঘস্থায়ী বৈকল্য।
কিডনির তাৎক্ষণিক বৈকল্য
সাধারণত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে যখন দেহের বর্জ্য অপসারণ ও ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে কিডনি অক্ষম হয়, সে অবস্থাকে কিডনির তাৎক্ষণিক বৈকল্য বলে। তীব্র ডায়রিয়া, রক্তক্ষরণ, হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেইলিউর, রক্তে পানি ও লবণের অভাব, ভুল রক্ত দেওয়া, তীব্র অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, মারাত্মকভাবে পুড়ে যাওয়া, তীব্র সংক্রমণ—এসব কারণে কিডনি তাৎক্ষণিকভাবে বিকল হতে পারে।
কিডনির দীর্ঘস্থায়ী বৈকল্য
কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে কিডনির কার্যকারিতা তিন মাস বা তার অধিক সময় পর্যন্ত লোপ পেলে তাকে কিডনির দীর্ঘস্থায়ী বৈকল্য বলে।
কিডনি রোগের প্রাথমিক লক্ষণ
● প্রস্রাব কমে যাওয়া, প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া হওয়া, এমনকি প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া।
● পাঁজর ও কোমরের মাঝামাঝি দুই পাশে ব্যথা হওয়া (Flank Pain)।
● শরীরে ফোলাভাব তৈরি হওয়া।
● মুখমণ্ডল, হাত–পায়ের পাতা, পা ও গোড়ালি ফুলে যাওয়া।
● ফুসফুসে পানি জমার কারণে ঘন ঘন শ্বাস নেওয়া।
● রক্তশূন্যতা হওয়া ও শরীর ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া।
● খাবারে অরুচি, তন্দ্রাচ্ছন্নতা, অনেকক্ষণ ধরে হেঁচকি তোলা, মুখে ধাতব স্বাদ অনুভূত হওয়া।
● রক্তে পটাশিয়ামের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে অসারতা ও অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন হওয়া।
দেহের গুরুত্বপূর্ণ এই অঙ্গের জন্য অবশ্যই ভালোভাবে যত্ন নেওয়া উচিত। কিন্তু আমরা কতটুকু সচেতন এর যত্নের ব্যাপারে? একটু সচেতন হলেই কীভাবে আমরা সুস্থ রাখতে পারি আমাদের কিডনিকে।
● পরিমিত পানি পান ও দীর্ঘক্ষণ প্রস্রাব আটকে না রাখা।
● কিডনি আমাদের দেহের দূষিত বর্জ্য পদার্থ প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয়।
● তাই পরিমিত পানি পান ও নিয়মমতো প্রস্রাব করার অভ্যাস কিডনিকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
এ বিষয়ে পাবনা জেনারেল হাসপাতালের ইউরোলজিস্ট ও ল্যাপারোস্কোপিক সার্জন কনসালট্যান্ট এ এস এম কুতুবউদ্দিন আওয়াল জানান, নিয়মিত দুই–তিন লিটার বিশুদ্ধ পানি পান ও প্রস্রাব আটকে না রাখার অভ্যাস কিডনির সুস্থতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সঠিক খাদ্যাভাস
কিডনিকে সুস্থ রাখতে, সঠিক খাদ্যাভাসের গুরুত্ব অপরিসীম। এ বিষয়ে কিডনি রোগবিশেষজ্ঞ, কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ, মানিকগঞ্জ, ঢাকার সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. রোকনুজ্জামান খান বলেন, কিডনিকে সুস্থ রাখতে, ফাস্টফুড, প্রক্রিয়াজাত খাবার, লবণযুক্ত খাবার, অতিরিক্ত প্রাণীজ আমিষ পরিহার করে শাকসবজি ও আঁশজাতীয় খাবার বেশি বেশি খেতে হবে। কিডনি সুস্থ রাখতে, কোমল পানীয় যতটা সম্ভব পরিহার করে চলতে হবে।
ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার করতে হবে
● ধূমপান রক্তনালিকে সংকুচিত করে রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়, যা কিডনির জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনে।
● ধূমপান ও মদ্যপানের ফলে কিডনির রক্তপ্রবাহ কমে যেতে পারে। এসব অভ্যাস থাকলে তা পরিহার করতে হবে।
ডায়াবেটিস রাখুন নিয়ন্ত্রণে
আপনার বয়স চল্লিশের বেশি হলে ডায়াবেটিস ও ব্লাড প্রেশার নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করুন। কারণ, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস কিডনি রোগের ঝুঁকি তৈরি করে।
উচ্চ রক্তচাপে বাড়ে কিডনি রোগের ঝুঁকি
যাঁরা দীর্ঘদিন উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন, তাঁদের কিডনি নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কারণ, উচ্চরক্তচাপ কিডনির রক্তনালিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করে।
ওষুধ গ্রহণে বিশেষ সতর্কতা
চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত কোনো ওষুধ, বিশেষ করে ব্যথানাশক ও অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া যাবে না। এগুলোর অযাচিত ব্যবহার কিডনিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
ওজন রাখুন নিয়ন্ত্রণে
● অতিরিক্ত স্থূলতা, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ নানাবিধ স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। এসব রোগ কিডনিকে নানাভাবে আক্রান্ত করে।
● কিডনিকে সুস্থ রাখতে আপনার ওজন রাখুন নিয়ন্ত্রণে।
অতিরিক্ত মানসিক চাপ পরিহার করুন
অতিরিক্ত মানসিক চাপে আমাদের দেহের নানান ধরনের হরমোনের তারতম্য ঘটে, যা রক্তচাপসহ দেহের স্বাভাবিক সব প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। কিডনিকে সুস্থ রাখতে যতটা সম্ভব চাপমুক্ত প্রফুল্ল জীবন যাপন করুন।
নিয়মিত শরীরচর্চা করুন
নিয়মিত শরীরচর্চার উপকারিতা অনেক। এর ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমে যায়, ফলে এটি আমাদের কিডনিকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
কিডনি পরীক্ষা করুন
যাঁদের স্থূলতা, উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস আছে, তাঁদের চিকিৎসকের পরামর্শে নিয়মিত কিডনি পরীক্ষা করা উচিত।
সচেতন হোন, আতঙ্কিত নয়
যদি আপনার কিডনির কোনো সমস্যা হয়, তাহলে আতঙ্কিত না হয়ে দ্রুত বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক চিফ কনসালট্যান্ট সার্জন ও বর্তমান সেন্ট্রাল হাসপাতালের কনসালট্যান্ট ইউরোলজিস্ট মেজর জেনারেল প্রফেসর ড. এইচ আর হারুন বলেন, ‘কিডনি রোগের প্রতিকার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এ রোগের লক্ষণগুলো সম্পর্কে সবারই ধারণা থাকা প্রয়োজন। কিডনির রোগসমূহের মধ্যে ক্যানসার অন্যতম। কিডনির ক্যানসারের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হলো পেইনলেস হেমাচুরিয়া অর্থাৎ প্রসাবে প্রদাহবিহীন রক্ত যাওয়া। অতীতে আমাদের দেশে কিডনিতে যেকোনো ধরনের ক্যানসার হলে পুরো কিডনিই ফেলে দেওয়া হতো। কিন্তু বর্তমানে শুধু টিউমার কেটে ফেলে বাকি সুস্থ কিডনিটুকু সংরক্ষণ করা যায়, যেটাকে বলা হয় নেফরন স্পেয়ারিং সার্জারি। উল্লেখ্য যে শুধু ২০ শতাংশ কিডনি নিয়েও সুস্থ জীবন যাপন করা যায়।’
ডা. মো. ফরহাদ পারভেজ: সহকারী সার্জন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, চাটমোহর, পাবনা।